বৈশ্বিক সংকট নিয়েও রাজনীতি কেন!

রাজনীতির লক্ষ্য জনসেবা, আরও বৃহত্তর অর্থে দেশসেবা। আর রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এ লক্ষ্যটিকে সামনে রেখেই এগিয়ে যাবেন, এটিই তো প্রত্যাশিত। বরেণ্য রাজনীতিকদের জীবন আলেখ্য পর্যালোচনা করলে ত্যাগ ছাড়া ভোগের ইতিহাস বিরল। 

বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু, মজলুমের কণ্ঠ মাওলানা ভাসানীসহ গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেসব রাজনীতিককে মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে এদের জীবনে তো ভোগ-বিলাসিতার ইতিহাস নেই, তাহলে তাদের অনুসারী হিসেবে দাবীদার তথাকথিত রাজনীতিকরা এত ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত কেন? ত্যাগেই যখন রাজনীতিবিদদের জীবন মহিমান্বিত হয়, তাহলে আজকের যুগে বিত্ত বৈভব আর ক্ষমতা নিয়ে এত কাড়াকাড়ি কেন?

বিজ্ঞানের কল্যাণে কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রিত হলেও এর অর্থনৈতিক খেসারত কাটিয়ে উঠার আগেই ইউক্রেন সংকটে সারা বিশ্ব আজ নতুন এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। জীবন যাত্রার ব্যয় নির্বাহে মানবিক মৌলিক চাহিদা পূরণ যেন আজ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কানাডার মতো দেশে দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় উৎপাতে নাগরিক জীবন যেন অসহনীয় হয়ে উঠছে। 

তিন ডলারের দুধ ছয় ডলার, আটারো ডলারের সয়াবিন তেল চল্লিশ ডলার, দুই ডলারের সবজি পাঁচ ডলার। গ্যাস, বিদ্যুৎ, ডিজেল, অকটেনের দাম বেড়েছে প্রায় শতভাগ। গাড়ি, বাড়ি, খাদ্য সবকিছুতেই ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে শতকরা চল্লিশ থেকে শতভাগ। জ্যামিতিক হারে ব্যয় বৃদ্ধি ঘটলেও আয় রোজগারে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন নেই।

রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতির কারণে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি আজ সংকটে। সময়ের পরিক্রমায় এ সংকটের আশু সমাধানের কোনো লক্ষণও নেই। তার সঙ্গে তাইওয়ান পরিস্থিতি নিয়ে নতুন সংকটের মুখে পূর্ব এশিয়া। মূল্য স্ফীতির চাপে নিত্যদিনের মৌলিক ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে বিলাসী জীবনেও এর চরম নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। বিশেষ করে আমদানি নির্ভর অর্থনীতির দেশে, এ সংকট পরিস্থিতিকে কোন দিকে নিয়ে যাবে তা বলা মুশকিল। বহু উন্নত দেশ বৈশ্বিক এই সংকটের চাপে যখন দিশেহারা, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই সংকট নিয়ে যেন রাজনীতির লম্ফঝম্প শুরু হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যয় সংকোচনের আহ্বান জানিয়েছেন। অতি প্রয়োজনীয় ছাড়া সব ধরনের প্রকল্পে কাটছাঁটের পরামর্শ দিয়েছেন। অনিবার্য কারণ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের সকল নিয়মিত বৈদেশিক সফর সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। সরকার গ্যাস, বিদ্যুতের ব্যবহারে জনগণকে সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। আগামী দিনের সংকট মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে এসব নির্দেশনা একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। আন্তর্জাতিক দাতাদের সাথেও আগাম পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের গৃহীত এসব পদক্ষেপ আর প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী আহবানকে স্বাগত বা সংকট মোকাবেলার বিকল্প উপায় উপস্থাপন না করে কিছু মানুষ একে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে যেন উঠে পড়েই লেগেছে। অন্যদিকে হঠাৎ করে ডিজেল, অকটেনের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণায় জনপদে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে।

এটি সত্যি- মূল্যবৃদ্ধির চাপে কানাডাসহ পৃথিবীর বহু উন্নত দেশে জনজীবন চরম সংকটের মুখোমুখি। তবে সেসব দেশের জনগণ, পরিস্থিতির জন্য সরকারকে দায়ী না করে সরকার ঘোষিত পদক্ষেপকে অনুসরণ করেই সংকট মোকাবিলা করছে। আর এবারের সংকটটিও যদি বৈশ্বিকই হয়, তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্নতর কেন? কোভিড-১৯ এর মতো বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবেলায় অনেক অপরাজনীতিকে মোকাবেলা করে শেখ হাসিনার সরকার সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। জনগণ পাশে থেকে পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারকে সহযোগিতা করেছে। প্রমাণিত হয়েছে, জনগণ চাইলে কোনো অপপ্রচার আর প্রপাগাণ্ডাই সফলতাকে প্রতিরোধ করতে পারে না। ইউক্রেন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট আর পূর্ব পশ্চিমের উত্তেজনা থেকে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির চাপে আগামী দিনের সংকট মোকাবেলায় শেখ হাসিনার সরকার কি সফল হতে পারবে?

৯০-পূর্ববর্তী সময়ে আটদল, সাতদলীয় জোট মাঠেঘাটে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত না করতে পারলে, সামরিক স্বৈরাচারকে বিদায় করা কি সম্ভব ছিল? জনগণ সঙ্গে না থাকলে ১৫ ফেব্রুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একদলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় কি সম্ভব হতো? জনমত হাসিনা, খালেদার পক্ষে ছিল বলেই তো ২০০৮ সালে সামরিক মদদপুষ্ট সরকারকেও বিদায় নিতে হয়েছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে কোনো ইস্যুতেই আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দেশপ্রেমের চেয়ে ক্ষমতাই মূল নিয়ামক হয়ে উঠে এতে ভিন্নমতের উপায় কোথায়? এবারের সংকটটি বৈশ্বিক হলেও, যে কোনো উপায়ে শেখ হাসিনার সরকারকে বিদায় করে ক্ষমতার পালাবদলই যে লক্ষ্য, সেসব আলামত তো দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হলো, আগামী দিনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার জনগণকে সঙ্গে পাবে তো? অপরাজনীতির মোকাবেলায় বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ কি প্রস্তুত?

ডিজেল, অকটেনের মূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও জনগণকে প্রস্তুত করার বিষয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের পরিকল্পনায় যে ঘাটতি আছে এটি দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। জনগণকে সাহস যোগাতে সরকার প্রধান দেশে পর্যাপ্ত তেল, গ্যাসের মজুতের তথ্যউপাত্ত উপস্থাপনের সপ্তাহ পেরোনোর আগেই ডিজেল, অকটেন, কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি জনমনে সংশয় সন্দেহ বৃদ্ধি করে আতংকজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জীবন যাত্রার মান পরিবর্তিত হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিসংখ্যানে মতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেক দেশের তুলনায় যথেষ্ট পাকাপোক্তই আছে, তবুও প্রবৃদ্ধির সুফল ভোগীদের নিয়ে নানারকম প্রশ্ন আছে! উৎপাদিত ফসলের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি, তার উপর নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সংগ্রাম করে কৃষক শ্রেণি যখন ক্লান্ত এই সময়ে ডিজেল, অকটেনের মূল্যবৃদ্ধি গ্রাম বাংলায় অসন্তোষ বাড়াবে তাতে সন্দেহ নেই, সেই সঙ্গে বিরোধী ক্ষমতালিপ্সুদের প্রপাগান্ডায় আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে।

বাড়ছে সারের দাম, লোডশেডিংয়ে আকাল জনগণকে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি আরও সংক্ষুদ্ধ করবে। প্রতি কেজি ইউরিয়াতে ৫৯ টাকা আর টিএসপিতে ৮৬ টাকা ভর্তুকির তথ্য জনগণের মাথায় নেই। সার উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার গল্প শোনালেও জনমনে ভর্তুকির তথ্যটি পৌঁছে দিতে শাসকদলের দায় এড়ানোর সুযোগ কোথায়? গ্যাস, বিদ্যুৎ, ডিজেল, অকটেন কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি যে আন্তর্জাতিক সংকটের ফল, সে তথ্যটি জনমনে পৌঁছে দিতে আওয়ামী লীগ কি সফল? একদিকে মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমছে, শাসক দলের দায়িত্বশীলদের এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য জনমনে সংশয়, সন্দেহ আর আতংককে বাড়িয়ে দিতে পারে। এহেন অবস্থায়, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনগণকে প্রস্তুত না করার সুযোগটি তো বিরোধীরা নিতেই পারে।

আওয়ামী রাজনীতির সুবিধাবাদী সমর্থক বাংলাদেশের এক শিল্পপতির সাথে অনেক দিনের জানাশোনা। সময় সুযোগে কথা হলেই ’৯৬ আর ২০০৮ এর আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। গেল সপ্তাহে তার মুখে বর্তমান সরকারের সুখ্যাতি শুনে মনে খটকা লাগে! কথা প্রসঙ্গে বললেন, এবারকার সরকার ব্যবসাবান্ধব! সেই সাথে সুবিধাবাদের নানা তথ্য উপাত্তও তুলে ধরলেন যা বঙ্গবন্ধুর দর্শন কৃষক, শ্রমিক মেহনতি মানুষের রাজনীতির সঙ্গে বেমানান। ভূমির মালিকানা একশ বিঘায় নির্ধারণ, পঁচিশ বিঘা অবধি জমির খাজনা মওকুফের মতো সিদ্ধান্ত জোতদার, জমিদারদের বিক্ষুব্ধ করবে জেনেও বঙ্গবন্ধু গরীব, কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের ভালোবাসায় তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।

বাংলাদেশের বাজারে একবার কোনো কিছুর দাম বাড়লে পরবর্তীতে সেই পণ্যের দাম আর কমে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ, ডিজেলের সাথে সংশ্লিষ্ট সব কিছুর দাম এক লাফেই বেড়ে গেছে। ‘আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেল, অকটনের দাম কমলে দেশের বাজারেও কমবে’ মন্ত্রীর এমন বক্তব্যেও জাতির মনে স্বস্তি নেই। বিগত কয়েক বছর আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েলের মূল্য উৎপাদন খরচের চেয়েও কম ছিল, তবুও বাংলাদেশের বাজারে পরিশোধিত জালানির দাম কমেনি। ভবিষ্যতে সরকার কঠোর নজরদারির মাধ্যমে ডিজেল, অকটেনের মূল্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও, পরিবহণের বর্ধিত ভাড়া কমিয়ে আনার সাধ্য কি আছে? যখন তখন ঠুনকো অজুহাতে যে পরিবহন নেতারা দেশকে অচল করে দেয়, নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের স্বার্থে আঘাত করার মতো সাধ্য, শক্তি সরকারের থাকবে কি? মাত্র কয়েক লক্ষ সরকারি কর্মজীবীর বেতন ভাতা বাড়লে ডাল, চাল, লবণ, তেলসহ সকল ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়, কোটি কোটি আমজনতা কপাল হাতড়ে জীবন কাটায়। এমন অভিজ্ঞতায় শংকিত জনতাকে উস্কে দিতে, সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদদের তৎপরতা জাতিকে কোথায় নিয়ে যাবে, এটি বলা মুশকিল।

‘কল্যাণের জন্য রাজনীতি’ বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় কথাটি যেন ক্রমেই অসাড় হয়ে পড়ছে। দল ক্ষমতায় থাকলে কিছু সুবিধাবাদী মোটাতাজা হয়, আর ক্ষমতার বাহিরে থাকলে ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়ে সত্য-মিথ্যা, হারাম-হালাল ভুলে যায়। রাজনীতি কতটা নির্লজ্জ হলে বিজ্ঞানের আবিষ্কার কোভিড-১৯ এর ভ্যাক্সিন নিয়েও মিথ্যাচার দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ঐক্যমতের উদাহরণ বিরল। যে দেশে জনস্বার্থের চেয়ে ক্ষমতার পালাবদলকে কেন্দ্র করেই রাজনীতি আবর্তিত হয়, বৈশ্বিক সংকট নিয়ে রাজনীতি সেখানে অস্বাভাবিক নয়। দুর্নীতি নির্মূলে জিরো টলারেন্সের ঘোষণাকে সর্বশক্তি দিয়ে বেগবান করে, আর সেই সাথে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারলে বৈশ্বিক সংকট নিয়ে অপরাজনীতির ফলাফলও একদিন মাকাল ফলের মতোই হবে।

spot_img
পূর্ববর্তী নিবন্ধফ্রান্স বিএনপির মতবিনিময় সভা
পরবর্তী নিবন্ধবর্তমান এমপির বিরুদ্ধে সাবেক এমপির চিংড়ি ঘেরে ডাকাতির অভিযোগ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে