এলন মাস্ক এর “STARLINK” এখন বাংলাদেশে! অবশেষে বাংলাদেশও স্যাটেলাইট ভিত্তিক নেটওয়ার্কে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। সম্প্রতি অর্থাৎ গত ২৬ জুলায় মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট এলন মাস্কের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক এর সাথে বাংলাদেশের একটি চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বের অন্যান্য ৭০টি দেশের মতো বাংলাদেশও ফাইবার অপটিকস সংযুক্তির পরিবর্তে স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেটে প্রবেশ করবে। বলা হচ্ছে এটি আমাদের ইন্টারনেট সেক্টরে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। তবে পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। এই আর্টিকেলে আপনাদেরকে স্টারলিংক কী, কীভাবে কাজ করে, এর সুবিধা, ঝুঁকিসমূহ পুরো বিষয়টি সহজ করে বিস্তারিত বুঝানোর চেষ্টা করবো।
প্রথমেই আসি স্টারলিংক কী এবং কীভাবে কাজ করে? স্টারলিংক তাদের কার্যক্রম শুরু করে ২০১৫ সালে, আর অফিশিয়ালি লঞ্চ করে ২০১৮ সালে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি ইন্টারনেট জগতে একটি আলোড়ন তৈরি করে। এটি মূলত একটি নিম্ন-আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট পরিষেবা যা ব্যবহারকারীদের একটি ব্রডব্র্র্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশন প্রদান করে। এই পরিষেবার সাহায্যে বিভিন্ন দুর্গম এলাকা, পাহারী অঞ্চল, দ্বীপ বা গ্রামাঞ্চলেও ভালো ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। আরেকটু সহজ করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। আমরা সমাই মুটামুটি এমন একটা পরিস্থিতির সাথে পরিচিত যে, শহর থেকে একটু গ্রামে গেলে ইন্টারনেট পেতে সমস্যা হয়, নেটের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে খোলা মাঠে বা রাস্তায় যেতে হয়। এর কারণ হচ্ছে আমরা বর্তমানে যে সাইবার অপটিকস ক্যাবলের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবাটি নিচ্ছি সেটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু স্টারলিংক এর স্যাটেলাইট ভিত্তিক এই নেটওয়ার্ক যেহেতু আকাশে বা কক্ষপথ থেকে সিগনালের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক সরবরাহ করবে তাই এতে শহর-গ্রামের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। সবজায়গায় আপনি একই স্পিডের নেটওয়ার্ক পাবেন।
স্টারলিংক যেহেতু স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা তাই এর সিগন্যাল রিসিভ করতে একটি অ্যান্টেনার প্রয়োজন হয়। অনেকটা আমাদের দেশে প্রচলিত ডিশের ছাতার মতো। তবে স্টারলিংকের অ্যান্টেনা আকারে এটু ছোট। ১ ফুট ছাতা দিয়ে আপনি স্টারলিংকের ইন্টারনেট সিগন্যাল যেকোনো প্রান্তে বসেই নিতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, ডিশ অ্যানটেনা ছাড়াও এ্যানড্রয়েড কিংবা IOS থেকে এর এপ্লিকেশনে ডাউনলোড করে Augmented Reality এর মাধ্যমে এর সাথে কানেক্টেড হতে পারবেন। আকাশ থেকে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট আপনাকে সিগনাল পাঠাবে আপনার অ্যান্টেনা তা রিসিভ করবে। সিগনাল পাঠানো থেকে শুরু করে রিসিভ করা পর্যন্ত টোটাল সময় লাগে ২০-৪০ মিলিসেকেন্ড। অর্থাৎ এক সেকেন্ডেরও কম!!! আর এটিকেই বলা হয় Latency Rate! লেটেন্সি রেট মানে এক পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে ডেটা স্থানান্তর করতে যে সময় লাগে সেটিকে বুঝায়। লেটেন্সি রেট এতো কম হওয়ায় আপনি এতো স্পিডের নেটওয়ার্ক পাবেন যা প্রতি সেকেন্ডে ৫০ থেকক ১৫০ মেগাবাইট!
এবার আসি মূল বিষয়ে। গত ২৬ জুলাই স্টারলিংকের সঙ্গে একটি পাইলট প্রকল্পে সম্মত হয় বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী তিন মাসের জন্য বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক ইন্টারনেট সরবরাহ করবে স্টারলিংক। এজন্য তারা দুইটি ডিভাইসও ইতোমধ্যে আমাদেরকে দিয়েছে। কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ডিভাইস দুটির একটি বসানো হবে বাসের ভেতরে এবং অন্যটি প্রত্যন্ত কোনো দ্বীপে। তারপর বাংলাদেশ চ্যাক করবে স্টারলিংকের সেবাটি মূলত কীভাবে কাজ করে বাংলাদেশে। তখন চূড়ান্তভাবে আমরা এই সেবায় প্রবেশ করবো। এবার আসি এতে সংযুক্ত হলে বাংলাদেশের জন্য কোন ঝুঁকি বা অসুবিধা রয়েছে কিনা?
এক. সোশ্যাল মিডিয়ার রাজনীতিকীকরন সবচেয়ে বেশি বড়ো আকার ধারণ করে ২০১১ সালের তিউনিসিয়ার আরব বসন্তের মধ্যে দিয়ে। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চলমান একনায়কতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে সেই আন্দোলনে জনসমাগম বা People Mobilization এর অন্যতম টুল হিসেবে ব্যাবহৃত হয়েছিল ফেসবুক। তারপর থেকেই মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো বিশ্বব্যাপী ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকে। রাজনৈতিক আন্দোলনের মূখ্য হাতিয়ার হয়ে উঠে সোশ্যাল মিডিয়া। যার ঢেউ বাংলাদেশে প্রথম এসেছিলো কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণেই এসব আন্দোলন বাংলাদেশ তীব্রতর হয়েছিল। একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিতে সোশ্যাল মিডিয়া ও রাজনৈতিক আন্দোলন একে অপরের পরিপূরক। সাম্প্রতিক সময়ের ইরানে হিজাব আন্দোলন, পাকিস্তানে জনগণের সাথে সেনাদের আন্দোলন, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক আন্দোলন ইত্যাদি আন্দোলনগুলো দমাতে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। যেহেতু ইন্টারনেট ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া সম্পূর্ণ অচল। আমরা অপটিকস ফাইবার ক্যাবলের মাধ্যমে ইন্টারনেটের যে সেবাটি নিচ্ছি তাতে রাষ্ট্র চাইলে খুব সহজে আন্দোলন দমাতে ইন্টারনেট পরিসেবা বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। কিন্তু স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেটে সে সুযোগটি আর থাকে না বলেই চলে। এখানে চাইলেও রাষ্ট্র হুট করে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। সেজন্য রাজনৈতিক ভাবে ভঙ্গুর অনেক রাষ্ট্রই স্টারলিংকের নেটওয়ার্ক সেবায় সংযুক্ত হতে অপারগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনের স্পিরিট তৈরি করে জনগণ যেন একসাথে না হতে পারে সেজন্য রাষ্ট্রগুলো ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা থেকে শুরু করে নানা পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে।
তবে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেকটা ভিন্ন। নতুন প্রযুক্তি স্টারলিংক বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হিসেবে এটি নিসন্দেহে আমাদের জন্য একটি বড়ো পাওয়া। তবে স্টারলিংকের নেটওয়ার্ক নিয়ে বাংলাদেশের আর্গুমেন্ট একটু ভিন্ন জায়গায়। স্টারলিংক বা এর CEO এলন মাস্কের উদ্দেশ্যই হচ্ছে পুরো পৃথিবীকে একটি স্যাটেলাইট ভিত্তিক নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা। তাই তারা যে সকল দেশে এই সেভাটি প্রোভাইড করবে সে দেশের সরকারের কাছ থেকে তারা কোন হস্তক্ষেপ বা Intervention আশা করে না! কিন্তু বাংলাদেশ বলছে যে, আমরা যদি পাইলট প্রকল্প শেষে ফাইনালি এই সেবার সাথে কানেক্টেড হই তখন এই নেটওয়ার্ক ব্যাবহার করে বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি সাইবার ক্রাইমে লিপ্ত হয় তখন বাংলাদেশ সরকার এতে বৈধ হস্তক্ষেপ করতে পারবে কিনা? এটি একটি বড়ো ইস্যু! বা স্টারলিংক একটি Non State Actor হিসেবে একটি দেশের রাজনৈতিক ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করবে কিনা সেটিও প্রশ্ন।
দুই.
যেহুতো স্টারলিংক আপনাকে অত্যন্ত High-speed এবং নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেটে সেবা দিবে সেহেতু এর মূল্য কিছুটা বেশিই হবে। এবং এটিই স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশে পাইলট প্রকল্পটি যাচাই বাছাই শেষে তাদের সঙ্গে ইন্টারনেটের দাম নিয়ে আলোচনায় বসবে আমাদের বিটিআরসি। সব প্রযুক্তিই যখন স্টার্টিং ফেইজে থাকে তখন এর সেবাগত মূল্য একটু বেশিই থাকে। মনে আছে প্রথমবার যখন বাংলাদেশে সিমকার্ড আসে, তখন এক মিনিট কথা বলতে কতো টাকা খরচ হতো? প্রথমদিকে নরমাল মোবাইল ফোনের মূল্য কতো ছিলো? তাই স্যাটেলাইট ভিত্তিক এই ইন্টারনেট প্রথমদিকে ব্যয়বহুল হলেও বিশ্বজুড়ে যখন এর ব্যাপক বিস্তার ঘটবে তখন ধীরে ধীরে এর দামও সাধ্যের মধ্যে চলে আসবে। তবে এলন মাস্ক লোক ভালো। যেসকল দেশ এই সেবার অধীনে গিয়েছে তারা বলছে যে, স্টারলিংক আমাদেরকে যতটুকু সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো তার তুলনায় প্রতিষ্ঠানটি অনেক বেশি সেবা আমাদেরকে দিচ্ছে, প্রতিশ্রুতির তুলনায় অনেক বেশি ইন্টারনেট তারা প্রোভাইড করছে!
তিন. বাংলাদেশে রবি, টেলিটক, বাংলালিংক, গ্রামিনফোনের মতো টেলি নেটওয়ার্ক যারা প্রোভাইড করছে তাদের সাথে স্টারলিংকের একটি অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। এলন মাস্ক যদি ভবিষ্যতে বা কয়েকবছর পর মানুষদেরকে এই নেটওয়ার্কের সাথে অভ্যস্ত করে তারপর অভিন্ন কোন সিমকার্ড বা মোবাইল লঞ্চ করে বসে তখন আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতে পারবে কিনা সেটিও একটি প্রশ্ন! তবে অনেকে বলেছেন এই প্রতিযোগিতার কারণে তাদের সেবার মান বৃদ্ধি পাবে এবং আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠান গুলো যে একচেটিয়া ব্যবসা বা Monopoly তৈরি করে রেখেছে সেটি থেকে অন্তত দেশের জনগণ কিছুটা মুক্তি পাবে।