১৩ বছরে শেষ হচ্ছে ১১ কিলোমিটার এলিভেটেড

এলিভেটেড

দেশে প্রথমবারের মতো নির্মিত হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল মহাসড়ক। উদ্দেশ্য, ওপর দিয়ে ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়া। কিন্তু সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলার এই প্রকল্প সহজে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। উল্টো এটি অপরিকল্পিত উন্নয়নের একটি উদাহরণ হয়ে গেল।

দেশে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি অন্যতম ধীরগতির প্রকল্প। ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি এর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু জমি বুঝে না পাওয়া, নকশায় জটিলতা ও অর্থায়নের অভাবে কাজ এগোয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত আগামী ২ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের আংশিক পথ চালু করতে যাচ্ছে সরকার।

অবশ্য কয়েক বছর ধরে প্রকল্পের একাংশ যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা জানিয়ে আসছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তাঁর সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ২ সেপ্টেম্বরে খুলে দেওয়া হবে কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশ। এ ক্ষেত্রে ১৩ বছর পর চালু হবে সাড়ে ১১ কিলোমিটার পথ। প্রকল্পের মূল সড়কের বাকি থাকবে আরো প্রায় ৯ কিলোমিটার।

এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে গিয়ে দেখা যায়, কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সড়কের কাজ প্রায় শেষ। কাওলা প্রান্তে ছয়টি টোল বুথ বসানো হয়েছে। বানানীর র‌্যাম্পেও টোল বুথ বসেছে। উদ্বোধন সামনে রেখে বিভিন্ন স্থানে রং করছেন শ্রমিকরা। সড়ক বিভাজকের ওপর বসেছে বিদ্যুতের খুঁটি।

বাতি বসানোর কাজও শেষ। রাতে এসব বাতি জ্বালিয়ে পরীক্ষাও করা হচ্ছে। শেষ হয়েছে সড়কচিহ্ন দেওয়ার কাজও।

গত ১৮ জুন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক্সপ্রেসওয়ে প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা আমি স্বীকার করি, এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎই ছিল না। আমি যখন আসি তখন শুধু ভিত্তিপ্রস্তর ছিল। প্রকল্পের টাকা বরাদ্দসহ কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা ছিল না।’

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটি অনেক চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প। শুরু যখন হয়ে গেছে তখন পথ থেকে সরে যাব, এটাও তো ঠিক না। সরে গেলে বাংলাদেশে প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপে (পিপিপি) প্রকল্প হয় না, এমন খারাপ ধারণা সৃষ্টি হতে পারত। সে জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি। এখন তো মোটামুটি একটা পর্যায়ে এসেছে।’

গতি ৬০, চলবে না ২-৩ চাকার যান

এই উড়াল মহাসড়কে যান চলার সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করেছে সেতু বিভাগ। সেই সঙ্গে দুই ও তিন চাকার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ফলে মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে পারছে না। আবার শুরুতে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত যান চলাচলে প্রকল্পের সুফল কতটা মিলবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, যেহেতু উড়াল পথ এবং যাত্রা হবে বিরতিহীন, তাই পথে যাত্রী নেওয়ার সুযোগ নেই। তার ওপর টোল দিতে হবে। ফলে বাসগুলো এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবে কি না তা এখনই বলা যায় না। তার তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি বেশি চলবে। তিনি বলেন, সড়কটি আংশিক চালু করায় এর সুবিধা এখনই পুরোপুরি বোঝা যাবে না।

হাদিউজ্জামান বলেন, পথটি চালু হলে তা ফার্মগেট এলাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আংশিক চালু হওয়ায় ফার্মগেটে কী পরিমাণ গাড়ির চাপ পড়বে সেটার একটা সমীক্ষা করার দরকার ছিল। আর শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের ওপর নির্ভরশীল এক্সপ্রেসওয়ে সহজে লাভের মুখ দেখতে পারার কথা নয়।

শুরুতেই খুলছে না সব র‌্যাম্প

পরিকল্পনা অনুযায়ী, রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত যাওয়ার কথা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এই পুরো পথ নির্মাণের জন্য কাওলা থেকে বনানী, বনানী থেকে মগবাজার ও মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। তবে এখন খোলা হচ্ছে প্রথম ভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগে অর্ধেক পথ।

প্রকল্পটি করা হচ্ছে সরকারি বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতে। এতে বিনিয়োগ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফাস্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কম্পানি লিমিটেড। সরকারের দিক থেকে ভুমি অধিগ্রহণসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয়। সঙ্গে মোট খরচের একটি অংশ দেয় সরকার।

প্রকল্পের অগ্রগতির প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। তবে খুলতে যাওয়া অংশের কাজ হয়েছে ৯৮ শতাংশ। উদ্বোধন অংশে র‌্যাম্প রয়েছে ১৫টি। এর মধ্যে বিমানবন্দর এলাকায় দুটি, কুড়িলে তিন, বনানীতে চার, মহাখালীতে তিন, বিজয় সরণিতে দুই ও ফার্মগেট এলাকায় একটি। তবে শুরুতে সব র‌্যাম্পে চলাচলের সুযোগ থাকছে না। কোন কোন র‌্যাম্প শুরুতে খুলবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

যদিও প্রকল্পের নির্মাণকাজ হচ্ছে তিন অংশে। এর মধ্যে প্রথম ধাপের দৈর্ঘ্য ৭.৪৫ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপের দৈর্ঘ্য ৫.৮৫ কিলোমিটার এবং তৃতীয় ধাপের দৈর্ঘ্য ৬.৪৩ কিলোমিটার। মূল পথ ১৯.৭৩ কিলোমিটার। সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠানামার জন্য পথ থাকবে ৩১টি। এই ওঠানামার পথসহ (র‌্যাম্প) সর্বমোট দৈর্ঘ্য দাঁড়াচ্ছে ৪৬.৭৩ কিলোমিটার।

এক প্রশ্নের জবাবে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, মূল সড়কের অবকাঠামোর জটিল ও বড় কাজগুলো আগেই শেষ হয়েছে। এখন শেষ মুহূর্তের খুঁটিনাটি কাজগুলো চলছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাতে এখনো এক সপ্তাহের বেশি সময় আছে। উদ্বোধন এলাকায় সামান্য যে কাজ বাকি সেগুলো এর মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।’

জমি অধিগ্রহণে বেড়েছে সময়

হাতিরঝিল, খিলগাঁও ও কমলাপুর—এই তিন অঞ্চলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জায়গা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। বিতর্ক শেষে হাতিরঝিলেও র‌্যাম্প নামছে। খিলগাঁওয়ে রেললাইনের পাশের জায়গা নিয়ে আপত্তি ছিল রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। তারও সমাধান হয়েছে।

রেল বলেছে, ভবিষ্যতে তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইনের পাশে আরো দুটি নতুন রেললাইন তৈরি হতে পারে। আর কমলাপুরে জটিলতা মীমাংসা করতে গিয়ে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের রেললাইনের নিচ দিয়ে আন্ডারপাস তৈরি করা হচ্ছে। এসব জটিলতার কারণে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ আরো পিছিয়ে যায়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের মধ্যে যেখানে কুতুবখালী পর্যন্ত উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল, সেখানে খুলছে ফার্মগেট পর্যন্ত।

নকশার জটিলতা নিয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ওটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আপাতত তেজগাঁও আমাদের টার্গেট।’

প্রকল্পের বাকি অংশের ভবিষ্যৎ কী জানতে চাইলে সড়কমন্ত্রী বলেন, ‘একটি-দুটি প্রকল্পে সমস্যা হতেই পারে। আমাদের দেশে তো এগুলো সব প্রথম।’

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করে জানান, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। তবে এই সময়ের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। তিনি জানান, যতটুক কাজ হয়েছে আরো প্রায় ততটুক বাকি আছে। ফলে প্রকল্পের সময় আরো বাড়বে।

পুরো এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাউন্ডিংয়ের আওতায় চুক্তি অনুযায়ী দুই হাজার ৪১৩ কোটি টাকা দেবে সরকার। বাকি টাকা ঠিকাদার বিনিয়োগ করবে। ২০২০ সালের শুরু থেকে ধরে পরের ২১ বছর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল আদায়ের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের টাকা তুলে নেবে।

যানবাহনগুলোকে চার শ্রেণিতে ভাগ করে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল, ১৬ সিটের কম মাইক্রোবাস ও তিন টনের কম হালকা ট্রাকের ক্ষেত্রে টোল দিতে হবে ৮০ টাকা। ১৬ বা তার বেশি আসনের সব ধরনের বাসের টোল ১৬০ টাকা। ছয় চাকা পর্যন্ত মাঝারি ট্রাকের টোল ৩২০ টাকা। ছয় চাকার বেশি ট্রাকের টোল ৪০০ টাকা।

পথের দূরত্ব বিবেচনায় টোল প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান তার লাভসহ টাকা তুলতে বাণিজ্যিকভাবে টোল নির্ধারণ করবে। তবে ২০১৩ সালে চালু হলে টোল এত বেশি হতো না।

শামছুল হক বলেন, এটা শহরের ভেতরের সড়ক। তাই ২৪ ঘণ্টা এই পথে গাড়ি চলবে না। নিচের সড়ক ফাঁকা থাকলে কেউ ওপরে উঠবে না। আবার বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত সড়কটি ভালো। ফার্মগেট পর্যন্ত চালু না হয়ে পুরো পথ চালু হলে চিত্র ভিন্ন হতে পারে। তবে এখন দেখার বিষয় এই উড়াল মহাসড়ক গাড়ি আকৃষ্ট করতে পারে কি না!

spot_img
পূর্ববর্তী নিবন্ধতিন মাসের জন্য পরিবারকে নিতে পারবেন সৌদি আরব প্রবাসীরা
পরবর্তী নিবন্ধমেয়ের স্বীকারোক্তি ‘বাবার গলা কেটে দিই, মা সাথেই ছিল’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে